সূর্যোদয় দেখা ও ছেঁড়া দ্বীপ:
সূর্য উঠার আগেই বেরিয়ে পড়লাম। দলের পাঁচ জন ঘুম থেকে উঠতে পারেনি, তাদের রেখেই আমরা চারজন সাগর পাড়ে পৌঁছে গেলাম।
সেদিন আকাশ টা কেন যেন অভিমান করে ছিল। একবার সূর্যিমামা একটু করে মুখটা বের করে আর অমনি আবার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায়। এভাবে কিছুক্ষন চলে আকাশে সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি খেলা।
পূর্ব দিগন্ত কিছুটা রক্তিম আভা ধারন করেছিল।সাগরের পানিতে সে আভার ছায়া দেখে আর নির্মল বাতাসে শিহরিত হচ্ছিলাম আমি আর আমার সমস্ত মনে দোলা দিচ্ছিল এক শিহরণ।
তবে মৃদুমন্দ বাতাসে খালি পায়ে বালুকাময় বীচে (কক্সবাজার)হাঁটতে যেমন আনন্দ এখানে তার উল্টো। বাতাসটা বেশ উপভোগ্য কিন্তু বালিগুলো ছিলো শামুক ঝিনুক আর ভাঙ্গা প্রবালে পরিপূর্ণ। তাই খালি পায়ে বেশীক্ষণ হাঁটা যাচ্ছিল না। সাগর তখন শান্ত।
সাগরের তীরঘেষে সারি সারি কেয়া আর নারিকেল গাছ, প্রচুর নারিকেল হয় বলে অনেকে এই দ্বীপকে নারিকেল জিঞ্জিরা ও বলে থাকে। গাছে গাছে নারিকেল ও কেয়ার ফল ধরে আছে।সব মিলে কি অপরুপ প্রকৃতি। আমাদের ছেঁড়া দ্বীপ যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে তাই সাগর পাড়ে ডাব খেয়েই রুমে ফিরলাম।প্রতিটা ডাব ৫০টাকা থেকে ৯০টাকা।বলা বাহুল্য ৯০টা দিয়ে একটা ডাব নিলে ৪ গ্লাস পানি খাওয়া য়ায়।আর নারিকেল ১৫টাকা থেকে ২০টাকা তাই দোকানিকে বলে রাখলাম কিছু নারিকেল ছিলে রাখতে ঢাকায় নিয়ে যাব বলে।
গতদিন আর সকালের অভিজ্ঞতা থেকে এবার সবাই জুতো পড়ে তৈরী হয়ে গেলাম। কিংশুকে রেস্তোরায় প্রাতরাশটা সেরে নিয়ে সবাই ঘাটের উদ্দেশ্য ভ্যানে চড়ে বসলাম। আমাদের গাইড মোঃ আমিন সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল।
আকা বাঁকা গাঁয়ের সরু বালুময় পথে ভ্যান চালাতে চালকের কষ্ট হচ্ছিল তাই মাঝে মাঝেই নেমে পড়তাম আমরা।সে এক অন্যরকম আনন্দ। আবহাওয়া সেইদিন এত চমৎকার ছিল যে কোন কাজেই তেমন ক্লান্তি ভাব কারোই হয়নি। আমরা ঘাটে পৌঁছে গেলাম উদ্দেশ্য স্পিড বোটে করে যাব ছেঁড়া দ্বীপ। তবে অনেকে পায়ে হেঁটে,অনেকে ট্রলারে আবার কেউবা ইঞ্জিন নৌকায়ও ছেঁড়া দ্বীপ যাচ্ছিল।
উঠে পড়লাম লাইফ জ্যকেট সহ স্পিড বোটে। প্রচন্ড ভোঁ ভোঁ শব্দে দুর্বার গতিতে ছুটলো বোট। দূর থেকে পুরো ছেঁড়া দ্বীপটার ছবিও তুললাম। বোট থেকে নামতে হলো প্রবালের উপর পা রেখেই। পুরো দ্বীপটাই ছোট বড়, সাদা কালো প্রবাল দিয়ে ঘেরা।পানির চার পাশে শুধুই প্রবাল আর প্রবাল।
ছোট্ট এই দ্বীপে কোন জনবসতি নেই।শুধু সারাদিন দর্শনার্থীদের কোলাহল।এমন স্বচ্ছ সাগরের পানি আর অনেক গভীরে ও দেখা যায় তার বুকজুড়ে আছে রাশি রাশি প্রবাল। চারপাশটা সেই কেয়া আর নারিকেল গাছে ঘেরা বালুচর। বাচ্চাদের সে কি আনন্দ।
সেন্টমার্টিন ফিরে দুপুরের খাবার শেষে বের হলাম কেনাকাটার জন্য। বিকেলে আবার সৈকতে। দৃষ্টি ফেলি দূর দিগন্তে, সন্ধ্যে তখন হয় হয়। একটু দূরে দেখা গেলো একটা বাঁশে মোটা দড়ি বেঁধে দড়ির শেষ মাথাটা সাগরে, পাঁচ ছয় জন বাঁশটা কাঁধে নিয়ে খুবই ধীর লয়ে টানছে। একমাথায় এরা আর বহু দূরে আরেক মাথাও এভাবে পাঁচ/ছয়জন মিলে টানছে।প্রায় এক-দেড় ঘন্টা পর জাল উপরে তুলে আনলে। কিযে সুন্দর রুপালি ছোট বড় নানা রকমের মাছের লাফালাফি। এদিকে সূর্যটা ধীরে ধীরে পানিতে ডুবে গেলো।
রাত বারোটার আগ পর্যন্ত আমরা কখনো সাগর পাড়ে পায়চারি, কখনো ঝালমুড়ি, আবার কখনো বা ডাবের পানি পান করেই সময়টা পার করেছি। বহু ছেলে মেয়ে ব্লু টুথ স্পিকারে জোরে জোরে গান বাজাচ্ছে যেন পানির ঢেউয়ের শব্দের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। তখন জোয়ারের সময় ছিল। একটুপর দেখি আমাদের সমনেই ফানুস উড়ানোর প্রস্তুতি চলছে, দুই একটা ফানুস উপরে উঠে গেলো আলোর ঝলকানিতে মুখরিত পরিবেশে ঠিক বারোটা এক মিনিটে স্পিকারে বেজে উঠলো ‘হেপি বাথ ডে টু ইউ’ মিউজিক। সবাই হাততালি দিয়ে উইস করলাম। কারণ ১৬ই ডিসেম্বর ছিলো আমার কর্তার জন্মদিন। আমার মেয়ে আর ভাসুরের মেয়ে মিলে তাদের বাবা, কাকার বার্থডে এমন সুন্দর পরিবেশ এত চমৎকারভাবে প্রেজেন্ট করবে বুঝে উঠতে পারেনি, রীতিমত আমরা সবাই সারপ্রাইজড।
সেন্টমার্টিনে শেষ দিন:
আজ তিনটার শিপে টেকনাফ পৌঁছে সাড়ে ছয়টার বাসে ঢাকা রওনা দিব, এই অভিপ্রায় নিয়ে দিনটি শুরু হলো। ভোরেই সাগর পাড়ে। আজ অন্যদিকের বেলাভূমি দিয়েই হাঁটছি।
ছোট ছোট কাঁকড়া গুলো আমাদের চলার শব্দে দৌড়ে গর্তে ডুকে পড়ছে।আমি ও দৌড়ে একটাকে ধরে নিলাম বেশ কৌশলেই। দুই একটা ছবি তুলে আবার তাকে ছেড়ে দিলাম।
এত সুন্দর বিস্তীর্ন নীল জলরাশির উপর বড় বড় পাথর সমেত প্রবাল দূর থেকেই মনকে টানছিল। দূরে মনে হচ্ছিল সাগরের মাঝখানে কেউ একজন প্রবালের উপর দাঁড়িয়ে কাছ থেকে যেন সাগরের জলকেলি দেখছে। সেই লক্ষ্যে প্রবাল ডিঙ্গিয়ে মাঝামাঝি পৌঁছে বুঝলাম, এতো কোন মানুষ নয়- মানুষাকৃতির একটি বিশাল প্রবাল। দেখে অবাক হলাম।
চারপাশে পানির নীল শ্রোতধারা।দুজনে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম আবার বালুচরে। অজস্র শামুক, ঝিনুক মাড়িয়ে যেতে যেতে আর লোভ সামলে রাখতে পারলাম না।কুড়াতে লাগলাম কিছু সাথে নিব বলে। পরে দেখি আমার মেয়েরাও ঝিনুক কাড়াচ্ছে,দুর থেকে দেখে খুব ভালো লাগলো।
এবার শুরু হলো আমাদের গোছগাছ। রুমে এসেই যার যার জিনিস পাতি গুছিয়ে নিয়ে বারটার দিকেই ঘাটে পৌঁছে গেলাম। এখনও কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা শেষে দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম। যথারীতি তিনটায় শীপে আগের মতই উঠে পড়েছি।
১৬ই ডিসেম্বর ছিল বিধায় জাহাজের মাস্তুলে একটা লাল সবুজের পতাকা তর তর করে উড়ছিল আর উচ্চ শব্দে দেশের গান বেজে চলছে – ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’। জাহাজ তো চলছে তার নিজের গতিতে কিন্তু গাংচিল গুলোর সাথে মনে হলো তার প্রতিদিনের বন্ধুত্বা। খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে আসে আর যায়। মাস্তুলে দাঁড়ানো মানুষ গুলোর মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কি এক আনন্দ খেলায় মেতেছিল তারা। লবিতে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম তাদের এই আসা যাওয়ার খেলা। মনে হলো কি দ্রুত কেটে গেলো দিনগুলো।#