শিউলি শবনম
(প্রথম পর্ব)
আগস্টের শেষ দিকে-অফিসের এক ব্যস্ত সন্ধ্যায় জোনায়েদ ভাইয়ের ফোন। বললেন, ‘কয়েক বন্ধু মিলে সান্দাকফু ট্রেকিং করতে চাই, তুমি যাবে’? নামটা কেমন খটমটে শোনাল। কয়েকবার শুনেও বুঝতে পারি না। জোনায়েদ ভাই আবারো ব্যাখ্যা করেন, ‘সান্দাকফু থেকে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো বিশ্বের চারটি সুউচ্চ পর্বতের দেখা মিলবে!’ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ তখনো আমার কাছে কেবল সত্যজিতের সিনেমা, কিংবা সিনেমায় দেখা স্মৃতি। নিমেষেই মনের কোণে ভেসে ওঠে নেপালি কিশোরটির গান। আর স্বপ্নের মতো অরূপ আলোয় জেগে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা! লাফিয়ে উঠে বলি, ‘নিশ্চয় যাবো।’
বান্দরবান, রেমাক্রির অল্প কিছু পাহাড় ডিঙ্গানো ছাড়া ট্রেকিংয়ে আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ চারদিনের ট্রেকিংয়ে আমাদের সান্দাকফুতে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ফিট উপরের দিকে ওঠা ও আবার সেখান থেকে ঢালু নিচে শ্রীখোলার দিকে নামাসহ হাঁটতে হবে মোট ৭০ কিলোমিটার।
জোনায়েদ ভাই দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘হাঁটার অভ্যেস থাকলেইে চলবে। প্রতিদিন এক-দু’ঘন্টা হাঁটা শুরু করো।’ সেই শুরু। ৩ হাজার ৬৩৬ মিটার উপরে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ সান্দাকফু ওঠার প্রস্তুতি নেয়া। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দু’মাস প্রতিদিন ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠেছি। ডিসি হিল ও সিআরবিতে হেঁটেছি, দৌঁড়েছি। শেষ সপ্তাহে প্রতিদিন দৌঁড়েছি প্রায় ৬ কিলোমিটার।
ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে অবশেষে ১০ নভেম্বর রওনা দিই আমরা ৭ জন। চ্যাংড়াবান্ধা-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির মায়াময় পাহাড়, সারি সারি চা বাগান, বাহারি ফুলের উতল করা হাতছানি পেরিয়ে, শীতঘন সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছে যাই মানেভাঞ্জনে। অঞ্জনের গানের মতো ‘সন্ধ্যেটা নামে বড় তাড়াতাড়ি এখানে’। সন্ধ্যে ৬ টায় ধোঁয়া ওঠা স্যুপ আর অনন্য স্বাদের চিকেন চাউমিন দিয়ে সেরে নিই রাতের খাবার। এক নেপালি পরিবারের আতিথেয়তা মাখা ফুল দিয়ে সাজানো আলো ঝলমল রেস্টুরেন্টে।
খাওয়া শেষে ট্যাক্সিতে চড়ে বসতে বসতে রিমঝিম বলল, ‘এখানকার বাড়িগুলো সুন্দর’। তা শুনে আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার, ভীষনরকম আমুদে যুবক বিনয়’দা বললেন, ‘মেয়েমানুষের চোখে বাড়ি-গাড়িই সব। এজন্য বিয়ে করিনি। এই গাড়িটাকেই বউ মেনেছি।’ তার বলার ধরন শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। বুঝতে পারি, মেয়েদের নিয়ে সস্তা রসিকতা করার চল সবখানেই আছে। আমরাও রসিকতাচ্ছলে বিনয়দাকে বুঝিয়ে দিই, পুরুষরা শিল্প বোঝে না! এই সুন্দর নিছক মেয়েমানুষের চোখ দিয়ে বলা নয়, এটা এখানকার শৈল্পিক কারুকাজের প্রশংসা।
গাড়ি থেকে হোটেলের সামনে নামতেই নেকড়ের গতিতে ধেয়ে আসে শীতের আক্রমন। পরনে থাকা উইন্ডচিটারকে থোড়াই কেয়ার করে শীত তখন সুতীব্র পরশ বুলাতে থাকে। ৩২ ডিগ্রি উষ্ণতার দেশ থেকে যাওয়া আমাদের অনভ্যস্ত শরীর ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অনবরত কাঁপতে থাকে। দ্রুত হোটেলে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকি ফ্রেশ হওয়ার জন্য। হায়! বেসিনের টেপ ছেড়ে যেই হাত দুটো পানিতে ভেজাই, মনে হলো, কেউ ছুরি দিয়ে ফালি করে কেটে নিয়েছে! বরফ শীতল পানির স্পর্শে প্রায় মিনিট কয়েক অসাড়, অনুভূতিশূণ্য হয়ে পড়ি। মনে হলো চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়বে এক্ষুণি! সেই হাড়কাঁপা শীতরাতে আমরা মোটা তোশকের নিচে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ি রাত সাড়ে আটটা বাজতেই। পরের ভোরে শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের রোমাঞ্চকর ট্রেকিং। চোখে স্বপ্নের ঘনঘোর নেশা। স্বপ্নে উঁকি দিয়ে যায় সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান ও তার বাহারি গাছপালা, হরেক পাখির কলতান, উঁচু-খাড়া পাহাড়ি জনপদ…।
প্রথম দিনের ট্রেকিং: মানেভাঞ্জন থেকে গৈরিবাস
পুলিশ ও সিঙ্গালিলা ন্যাাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষের ফর্মালিটি সেরে ১১ নভেম্বর সকালে আমরা ট্রেকিং শুরু করি মানেভাঞ্জনের ২১০০ মিটার উচ্চতা থেকে। আগের সন্ধ্যের শীতের তীব্রতা তখন যেন একটু ফিকে হয়ে এসেছে, নয়তো আমার অভ্যস্ত হয়েছি। তারপরও টাচস্ক্রিন মোবাইলে ছবি তোলার প্রয়োজনে যেই হাতমোজা খুলি, অমনি কনকনে ঠান্ডায় হাত জমে যাওয়া ও ধারালো ব্যথা টের পেতে থাকি। দু’একজন ছাড়া সবাই তখন ফুলপ্যাকড। টিশার্ট, ডাউনজ্যাকেট, উইন্ডব্রেকার, মাফলার, কানটুপি, মাস্ক, হাতমোজা…এরকম বিভিন্ন লেয়ারে মোড়ানো আমাদের শরীর। কেউ কেউ আবার উষ্ণতার জন্য রাতে পরে থাকা সিনথেটিক ইনার না খুলেই বের হয়েছেন ট্রেকিংয়ে! মানেভাঞ্জনের খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে কয়েকমিনিট উপরে উঠা শুরু করতেই আমরা টের পাই গরমের তীব্রতা! প্রত্যেকেই পাহাড়ের ঢালুতে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে রেখে একে একে খুলতে থাকি লেয়ার। লেয়ার তো মুক্ত হলাম কিন্তু মানেভাঞ্জনের নাকের মতো খাড়া পাহাড় ডিঙাতে শুরু করেই আমি হাঁফিয়ে উঠি। পা ধরে আসে। মনে হতে থাকে আমার গত দুই মাসের সাধনা কোনো কাজেই আসছে না। দেখি বাকিদেরও কেউ কেউ পাহাড়ের ঢালুতে, রাস্তার পাশে ব্যাকপ্যাক, ট্রেকিং পুল ফেলে দিয়ে বসে পড়ে। আমাদের ২২ বছর বয়েসী নেপালী গাইড ‘প্রবেশ’ শর্টকাট রাস্তা ধরতে গিয়ে আমাদেরকে আরো খাড়া পথ ধরে নিয়ে যায়। তাতে আরো বেশি হাঁসফাঁস করতে থাকি আমরা।
তবে দ্রুতই নিজেদের লক্ষ্যে, ট্রেকে ফিরি প্রত্যেকেই। সিঙ্গালিলা উদ্যানের সুউচ্চ-ঘন-সবুজ পাইনের সারি, বাহারি রডোডেনড্রন জঙ্গল, ওক, ঝাউবনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কখন যেন ভুলে যাই পেছনে ফেলে যাওয়া মুখর নগরজীবন। ঘন-শ্যামল-শান্ত সিঙ্গালিলা ও মেঘ জড়ানো সুনীল আকাশ সত্যিকার অর্থে আমাদের বিবশ করে রাখে। কাঁধে আট-দশ কেজি ওজনের ব্যাকপ্যাক, হাতে ট্রেকিং পুল নিয়ে আকাঁবাঁকা-এবড়োথেবড়ো পাহাড়ি পথ ধরে ঘোরগ্রস্থ হাঁটতে হাঁটতে বিস্তৃত এক প্রান্তরে এসে হঠাৎ আমাদের চোখ স্থির। গতিও শ্লথ হয়ে পড়ে। তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে কামরুল বলে, ‘এটাতো কাশ্মীর!’ মাত্র দুই কিলোমিটার ট্রেকিং শেষে পৌঁছে যাওয়া সে মায়ময় স্থানের নাম ‘চিত্রে’।
মুহূর্তেই কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাক ঘাসের উপর ছুঁড়ে ফেলে চিৎপটাং শুয়ে পড়ে কেউ। কেউ ছবি, কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু আমাদের গাইড প্রবেশ শান্ত, চুপচাপ। পাহাড়ের একপাশে গিয়ে যোগীর মতো বসে থাকে। পুরো ট্যুরে সে তার গা থেকে কোনো পোশাক খোলেওনি, ঠান্ডার প্রয়োজনে বাড়তি পোশাক যোগও করেনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইরকম। ¯্রফে একটা পাতলা জ্যাকেট, মাথা-কান ঢাকতে বালাক্লাভা ও ছোট্ট ব্যাকপ্যাক নিয়ে সে নীরবে পথ চলে, নয়তো পাহাড়ের টিলায় বসে টিমের সব সদস্যের জন্য অপেক্ষা করে। আর আমাদের যা অবস্থা, এমন সুন্দর দু’চোখ ভরে দেখা, অনুভব করা যেন অনন্তকাল ধরে চললেও থামবে না। থামছে না কারো ক্যামেরার ক্লিকও। এই সময় টিম লিডার, তারচেয়ে বেশি বন্ধু, জোনায়েদ ভাইয়ের ডাকে আমরা ছবি তোলা বন্ধ করে দ্রুত খেতে ছুটি। ঠান্ডায় জমে যাওয়া প্রত্যেকেই গরম গরম ব্রেড-অমলেট খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠি। নিজেদেরকে নিজেরাই মনে মনে বলি হ্যাপি ট্রেকিং!!
আবারো শুরু করি হাঁটা। লক্ষ্য নেপাল বর্ডারে তুমলিং গ্রাম পর্যন্ত টানা ১৩ কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া। দুপুরের মধ্যেই। উঁচু-নিচু পাহাড়ের মাঝে পথ বের করে গাইড আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। সিঙ্গালিলার সহ¯্র বাঁশঝাড়, বাহারি অর্কিড, ক্যাকটাস, ম্যাগনোলিয়ার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা গভীর পাহাড়ি পথ হাঁটি। পথে দেখা মিলে যায় বহু ট্রেকিং গ্রুপের সাথে। কোনো কোনো গ্রুপ নিজেরা ট্রেকিং করলেও মালপত্র তুলে দিয়েছে ঘোড়ার পিঠে। বেচারা ঘোড়া দুলতে দুলতে সেই বোঝা টেনে নিয়ে যায় তাদের পাশে পাশে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে শুকনো খেজুর, বাদাম, চকলেট মুখে দিয়ে এক চুমুক পানিতে নিজেদের ভেতর শক্তি ফিরিয়ে আনি।
টিমের সবচেয়ে কম বয়েসী সদস্য মাজেদ হাঁটে সবার আগে, দ্রুত। আর সবার আগে ক্লান্ত হয়ে সে পাহাড়ের খাদে বসে পড়ে, বিশ্রাম নেয়, সেলফি তোলে, ঝটপট ছবি তোলে। আবার ইয়োগা স্টাইলে বসে টান ধরে যাওয়া পেশিকে সচল করে। ওদিকে রিমঝিম, কামরুল হাঁটে সবচেয়ে ধীর গতিতে। শক্তি সঞ্চয়ে রেখে সবার পেছনে! কোথাও কোথাও ছবি তুলতে তুলতে তারা আরো পিছিয়ে পড়ে। জোনায়েদ ভাই মাঝে মাঝে তাড়া দেয়। ‘অনেকদূর যেতে হবে আমাদের’। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে দেবতাকে নিবেদনে মানুষের সেকি মহা আয়োজন! বনের ধারে, পাহাড়ের ঢালুতে দৃষ্টি নন্দন সব বৌদ্ধমঠ। রঙ-বেরঙের টুকরো কাগজ, কাপড়, ছোট ছোট পাথর দিয়ে সাজানো মন্দিরের চারপাশ। স্থাপনার গায়ে বুদ্ধের অজ¯্র কারুকাজ করা মূর্তি। বাতাসে যখন সেসব রঙিন কাগজ, কাপড় পতপত করে উড়ে তখন যেন অন্য এক আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে! … চলবে